-->

মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র অনিল ঘড়াইয়ের কথাশিল্পে গ্রাম-জনপদ - ড. চঞ্চলকুমার মণ্ডল

 

মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র অনিল ঘড়াইয়ের কথাশিল্পে গ্রাম-জনপদ - ড. চঞ্চলকুমার মণ্ডল

 

ওইটি আমার গাঁ

আমার স্বর্গপুরী,

ওইখানেতে হৃদয় আমার 

হয়ে গেছে চুরি!

প্রত্যেক কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের লেখনীতে এমনি, গ্রামের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, গ্রাম জীবনের প্রতি অপার স্নেহ এমনকি; গ্রামের মাটির প্রতি দুর্বার টানও অফুরন্ত ভালোবাসা বার বার উৎসারিত হয়ে উঠেছে। কবি জসীমদ্দিন থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত সকল কবি এমনকি; কথাশিল্পীদের কলমে সেই গ্রাম-জীবনের মাটি ও মাটির শেকড়সুদ্ধ গাছপালা, পশু-পাখি সহ মানব জীবনের সমগ্র চালচিত্র গ্রামজীবনের মনোরম প্রকৃতির অনুষঙ্গে বার-বার ধরা পড়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসে মেদিনীপুরের রসুলপুর নদীকেন্দ্রিক গ্রাম জনপদের সজীব ছবি লেখকের নৈসর্গিক চিত্রশালায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে অথচ, জন্মগতভাবে বঙ্কিমচন্দ্র ভিনজেলা তথা চব্বিশ পরগণার অধিবাসী কিন্তু এই জেলার স্বভূম স্বক্ষেত্র থেকে উঠে আসা লেখকদের মধ্যে রমাপদ চৌধুরী থেকে শুরু করে এই সময়কার কথাশিল্পী ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা, গুণময় মান্না সহ একঝাঁক নবারুণ কথাশিল্পীদের লেখনীতে এই মেদিনীপুরের নারায়ণগড়, কেশিয়াড়ি, কেশপুর, শ্যাওড়া, শ্যামগঞ্জ, ধানগাছিয়া, শীরষা, কেঁচকাপুর, ঝাঁকড়া, শালবনি, রোহিণির মত প্রতিটি অঞ্চল কেন্দ্রিক গ্রাম-জনপদের চালচিত্র উঠে এসেছে যে চালচিত্র নির্মাণে স্থান ও কাল এবং সেই ভৌগোলিক স্থান নির্ধারণকারী পরিবেশের উপযোগী পাত্র-পাত্রীর জীবনছবি অতিবাস্তববাচিত রূপে ধরা পড়েছে 

তেমনি, পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা থানার অন্তর্গত এক অখ্যাত গাঁ রুক্মিনীপুরে জন্মলাভ করে, কথাশিল্পী অনিল ঘড়াই তার সমগ্র সাহিত্য সাধনায় সেই গ্রামের মাটি, জল-হাওয়া এমনকি, বৃক্ষ ও বৃক্ষের শেকড়সুদ্ধ গ্রাম-জনপদের চাক্ষুষ ছবি তিনি মুহূর্তমাত্র এড়িয়ে থাকতে পারেননি খুব অনায়াসেই তাই তার সমগ্র কথাশিল্প জুড়ে বার-বার ঘুরে-ফিরে এসেছে ঐ গ্রাম-জনপদের জঠর সংগ্রামের সংকল্পঘন বাস্তব চালচিত্র মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র হিসাবে তা ‘পরীযান গল্পশিল্পে সেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলা এগরা-কাথি এলাকা সংলগ্ন অখ্যাত রুক্মিণীপুর গ্রাম-জনপদের নিখুঁত-চাক্ষু ছবি ধরা পড়েছে ল্পটির শুরুতেই জীন কষে বেহারাদের পদচারণার শব্দের সঙ্গে উঠ এসেছে দাউপু-গ্রামের নাম ‘পরীযান চলেছে দাউদপুর মুখে এভাবে, নানকা গা পূর্ব মেদিনীপুরের সেই প্রত্যন্ত গ্রা-জনপদের ছবিতে ধরা পড়ে- ‘তাঁতী বাড়ির পাশ দিয়ে মাকুর মত সরু রাস্তা রাস্তা ভাঙ্গা পড়িয়ার মাঠ সহ গ্রাম-জনপদের চির চলমান ছবি হিসাবে ক্রমশ উঠে এসেছে, ‘হাঁটু সমান উঁচু আল, গোরুর গাড়ির চাকার দাগে পথ সেই পথ বুক চিতানো ঢোঁড়া সাপ হয়ে পঞ্চায়েতী বাঁধের উপর হামলে পড়েছে এভাবে, গ্রাম-জনপদের অতি সজীব এক চলমান ছবি গল্পের পাতার পর পাতা জুড়ে উঠে এসেছে বালিঘাই সহ অজ এমন গ্রামের মেঠো পথ ধরে পরীযান কাঁধে এগিয়ে চলা বেহারাদেব দুলকি চালের পদ শব্দে জীর্ণ ঐ জনপদের ছবি ধরা পড়েছে 

বালিগড় গল্পে দীঘা-চন্দনেশ্বর এলাকা সংলগ্ন তালসারির গ্রাম সহ খড়িকাহাটের জনপদের জঠর যুদ্ধের লড়াকু ছবি উঠে এসেছে 'কটাশ' গল্পে মেদিনীপুরের পটাশপুর থানার গ্রাম-জনপদের জীবনচিত্রণে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আয়ু হিসাবে কটাশের উপমিত রূপকে ধরা পড়েছে প্রকৃত ভাম অর্থাৎ কটাশ-

পটাশপুরের কটাশ গো, ধড়িবাজের রাজা

কুঁকড়া ধরে, মৎস্য মারে, 

তার হবেনি সাজা?

এভাবে মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র হিসেবে অনিল ঘড়াই এই জেলারই অনেক অচেনা অজানা গ্রামে পৌঁছে যেতেন ছুটির দিনগুলোতে ফলত নদী কিম্বা, কোনো পুষ্করিণী ঘেরা গ্রামে পৌঁছে যেতেন কখনো কসাই, কপালেশ্বরী কিম্বা কেলেঘাই, রূপনারায়ণ নদীর চরভূমি ধরে পৌঁছে যেতেন প্রত্যন্ত গ্রাম-জনপদঘেরা বিস্তৃত অঞ্চলে ফলে তার সবকটি গল্প উপন্যাস হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক উপাদানে সমৃদ্ধ-লোকায়ত শিল্প ফসলে ভরা গবেষণাধর্মী জীবনগন্ধী প্রতিটি কথাকলার ভেতর দিয়ে তিনি এঁকে গেছেন অজস্র গ্রাম-জনপদের চিরায়ত চলমান ছবি এ প্রসঙ্গে স্বয়ং কথাশিল্পীর একপট স্বীকারোক্তিতে শোনা যায় ঐ গ্রাম-জনপদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার - এত বিপুল ভালোবাসার কারণ হিসেবে, 

আমি আবহমান গ্রামেই মানুষ... গ্রামই আমার প্রাণ, ভালোবাসার আশ্রয়স্থল গ্রামের মানুষকে যেভাবে দেখেছি, চিনেছি রাতদিনের সঙ্গী হয়ে - সে ছবিই এঁকে যাই তাদের গল্প আমি শোনাতে চাই (প্রতিক্ষণ প্রকাশিত গল্প সংকলনের আগের কথা)

আর সেই গল্প শোনাতে গিয়েই উঠে এসেছে অখণ্ডিত মেদিনীপুরের অজস্র প্রান্তিক গ্রাম-জনপদের জীবন্ত সব চির-চলমান ছবি। 

তার প্রথম উপন্যাস 'নুনবাড়ি' (১৯৮৯)তে পূর্ব মেদিনীপুরের রূপনারায়ণ নদী কেন্দ্রিক সমগ্র কলোনি গোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার চালচিত্র ধরা পড়েছে যে জীবন চিত্রের অনুষঙ্গে ঐ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহর সংলগ্ন নোনাখাল, গঞ্জেরহাট এলাকা জীবন ছবি, লবঙ্গ নামের একটি স্বামী বিতাড়িতা নারীর বিশাল-বিপুল জঠর সংগ্রামের অনুষঙ্গে রুদ্ধশ্বাস ঘনরূপে ফুটে উঠেছে 

 আবার দীঘা সমুদ্র এলাকা সংলগ্ন পানিপারুল, চোরাপালিয়াসহ এগর, হাড়িসাই প্রভৃতি গ্রাম-জনপদের জীবন-জীবিকা লড়াইয়ের বিপুল ঝক্ষাসংক্ষুব্ধ ছবি পড়েছে কথাশিল্পী 'মেঘজীবনের তৃষ্ণা' (১৯৯৬) উপন্যাসে যে উপন্যাসের ছত্র-ছত্রে বিচিত্রা পেশার মানুষের সন্ধান মিলে যাদের জীবন-জীবিকা প্রণালী বড় বৈচিত্র্যময়। এদের ঝাড়ুদার, কেউ বালিগড় পাচার করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে; কেউ বা মাছ কারবারি। যে এলাকার জীবনগুলোর সঙ্গে স্বয়ং কথাশিল্পীর নাড়ির যোগ রয়েছে তাই ঐ সময় হাড়িসাই অঞ্চলের গ্রাম-জনপদের নিখুঁত চালচিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ উঠে এসেছে 

নীল দুঃখের ছবি' (২০০১) উপন্যাসের পটভূমি হিসাবে উঠে এসেছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা-২ থানার অন্তর্গত বালিঘাই ও তার সংলগ্ন মাঠপুকুর এলাকা চিরভ্রাম্যমান কাকমারা সম্প্রদায়ের জীবনছবির পদচারণায় উঠে এসেছে সাহাড়দা, তাজপুর বলি সহ ভবানীচক, কেউটগড়িয়া এমনকি, কেলেঘাই নদীওযে সব গ্রাম জনপদকে ঘিরেই সন যাযাবর কাকমারা সম্প্রদায়ের নর-নারীর জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে সামান্য উদকাঠি, নজরকাঠি, তাবিজ বিক্রি করে; ঝাড় ফুক দিয়ে দু'-চারটাকা রোজগারের ধান্দা করে 

আবার ঐ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা থানার অন্তর্গত নানকা, হাতিদা নামের অখ্যাত গ্রাম-জনপদের ছবি উঠে এসেছে লেখকের বিপরীত যুদ্ধে মহড়া' (২০০১) উপন্যাসে। শুধু ঐ দুই গাঁ নয়; কেলেঘাই নদী থেকে শুরু করে সেই পূর্বালোচ্য পরীযা' গল্পে উঠে আসা দাউদপুর, ডাকাপাড়িয়ার মাঠ সহ নোনাখাল, কুদীখাল, বেলদা, খাকুড়দা, এগরার মতো সব গ্রাম-জনপদে চাক্ষুষ ঘনছবি 

অনিল ঘড়াই তাঁর চোখে দেখা অতিচেনা বাস্তব গ্রাম-জনপদের ছবি বার-বার তুলে ধরেছেন একাধিক উপন্যাসে। তেমনি নেগুয়া গ্রামকে কেন্দ্র করে সামনে সাগর (২০০৩) উপন্যাসের সূত্রপাত ঘটেছে ক্রমশঃ উপন্যাসের কাহিনীসূত্র ধরে উঠে এসেছে বইচা, জুমকী, দীঘা, এগরা, কুদী, কাঁথি, সাতমাইল, রামনগর, জুনপুট, শঙ্করপুর সহ খড়পুর পর্যন্ত এই উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর পদচারণা ঘটেছে দীঘার সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার মতাে চোরাপালিয়া, পানিপারুল সহ অজস্র গ্রাম-জনপদের জীবনচিত্র ফেনায়িত হয়ে উঠেছে ঐ সমগ্র উপন্যাসের কাহিনীস্রোতে। যে উপন্যাসে ঐ দীঘার সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গ্রাম-জনপদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম-সংকল্পঘন ছবি উঠে এসেছে মহাজনদের মাছঘাটির ব্যবসা, শুঁটকী মা তৈরির পদ্ধতি সহ জঠর সংগ্রামে টিকে থাকা গ্রাম-জনপদের নিরন্তর সংগ্রামের জীবন্ত সব ছবি 

মেদিনীপুরের চোরাপালিয়া থেকে খড়গপুর শহরের কৌশল্যা মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত গ্রাম-জনপদের ছবি ধরা পড়েছে লেখকের 'রাধা' উপন্যাসে পরিচারিকা রাধার ভাগ্যহত জীবন আলেখ্যে উঠে এসেছে গোলবাজারের ছবি যে রাধা নামের মেয়েরা কোনোদিন কপালে সুখ পায় না সেই বাসার বিড়ম্বিত জীবনালেখ্যর ভেতর দিয়ে গ্রাম ও শহর দুই ভিন্ন পরিবেশের ছবি উপন্যাসে উঠে এসেছে যেখানে ঐ রাধা নামের মেয়েদের মধ্যে গ্রামের সেই অগাধ দুর্বার সারল্য খুঁজে পাওয়া যায় আর ঐ মমতা কিম্বা, সাতার মত নারীদের স্বভাব চাঞ্চল্য শহরের হাঁমুখো জীবনের মতো যে জীবনের মাঝে রাধা-রা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না তারা দমবদ্ধ হয়ে হা-হা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে 

এভাবে, স্বয়ং কথাশিল্পী অনিল ঘড়াই জীবনের ক্ষণ আয়ু দিয়ে চিরন্তনের দীর্ঘ পথৱেখা নির্মাণ করে গেছেন এ বিষয়ে তিনি তার অমৃতলোকে যাত্রার পূর্বে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণাও করেছিলেন, কর্ম সাধনা প্রসঙ্গে

জোয়ারে এসেছি আমি, চলে যাব ভাটার 

ধমনীর মত রেখে যাব পথ, আমার কীৰ্তিচিহ্ন

 এই কীর্তি চিহ্নের চিরায়ত স্বাক্ষর হিসেবে রয়েছে - এমন সব অজ চলমান গ্রাম-জনপদের সচল-সজীব ঘনছবি এঁকে যাওয়ার ভেতর দিয়ে এখানেই অনিল ঘড়াইয়ে কর্ম এবং নিরলস শিল্প সাধনা সার্থক এখানেই মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র হিসাবে অনিল ঘড়াই চিরগৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে থাকবেন কেবল, মেদিনীপুর বাসীর কাছেই নয়, সকল বাংলা সাহিত্যের পাঠকের হৃদয়ে